মহেশ- 'দ্যা কাউ' (শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' অবলম্বনে)

গ্রামের নাম কাশিপুর । এক বিতর্ক অনুষ্ঠান শেষ করিয়া তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় রোদে পুড়িয়া বাড়ি ফিরিতে ছিলনে । বৈশাখ শেষ হইয়া আসে তবুও চারিপাশে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ অবস্থা’ । জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে আগুন ঝরিতেছে । পথের ধারে গফুর মিয়ার বাড়ি । বাড়ি তো নয় যেন প্রাচীন প্রত্ন তাত্ত্বিক নির্দশন । পাশের পিটালি গাছের ছায়ায় দাঁড়াইয়া তর্করত্ন উচ্চকন্ঠে ডাক দিলেন ‘ওরে, ও গফরা বলি বাড়ি আছিস?’ হাঁক শুনিয়া গফুর অন্দরমহল হইতে বাহির হইয়া আসে ।

ভাঙ্গা প্রাচীরের পাশে বাবলা গাছের তলে একটা ষাঁড় দেখাইয়া তর্করত্ন কহিলেন, তুই তো বড় পাষণ্ডরে গফরা । একি হাল গরুটার । পাঁজরের হাড় স্পষ্ট গোনা যাচ্ছে । তুই ওকে ‘খড়লিক্স’ দিতে পারিস নে ? এতে যে ঘাসের শক্তি বাড়ে রে গফরা, আমার গরুকে আমি রোজ খাওয়াই । গফুর কি বলিবে খুজিয়া পায় না , শেষে গেঞ্জি খুলিয়া তাহার জিরো ফিগার দেখাইয়া বলিল ‘মহেশের হাড় তো দেখিলেন বাবাঠাকুর, এইবার আমারটাও একটু দেখুন। ২০৬ খানা হাড় স্পষ্ট গুনিতে পারিবেন । গুনিলে হয়ত দুতিন খানা কমও পাইতে পারেন ।’

এমন লিকলিকে শরীর দেখিয়া তর্করত্ন দুঃখিত হওয়ার বদলে খিকখিক করি হাসিয়া কহিলেন ‘তোর তো আর এক্স-রে করা লাগবেনা রে গফরা , উদাম গায়ে ছবি তুলে দিলেই হবে । সে যাক, এমন ‘মিনিপ্যাক’ গরুর নাম রেখেছিস মহিষ । হেসে বাঁচি নে ।’ গফুর লজ্জিত হইয়া বলিল ‘মহিষ নাতো বাবাঠাকুর, মহেশ । ঐযে ‘মার্ডার’ সিনেমা আছেনা ? ওর পরিচালকের সাথে মিলিয়ে রাখলাম । আমার মহেশ ওসব সিনেমার খুব ভক্ত যে ।’ তর্করত্ন বিষমের কাশি দিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাইতে কহিলেন ‘তা তোর মেয়ে আমিনাকে দেখছিনা যে ।’ মাথা চুল্কাইয়া গফুর বলিল ‘সেতো মনে হয় জলসা দেখিতে ব্যাস্ত ।’ তর্করত্ন চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, একি বলছিস গফরা । গ্রামে ‘জলসার আসর’ আর আমি কিছু জানিনে ? গফুরও ভুল ভাঙ্গাইয়া দেয় ‘ওতো টেলিভিশনের জলসা । ঐযে, দুষ্টুর নাটক হয় যেখানে ।’ তর্করত্ন বলিলেন, শিষ্টের নাটক বাদ দিয়ে দুস্টুর নাটক ? একি হচ্ছে আমার কাশিপুরে ? গফুর হাসিয়া কহিল ‘শুধু কাশিপুর না বাবাঠাকুর, পুরো দেশটাই দুস্টুর দখলে চলে যাচ্ছে ।

মা মরা মেয়ে আমার ওই নিয়েই পরে থাকে ।’ তর্করত্ন বুঝিলনে আর তর্কে গিয়া লাভ নাই । একটু নরম হইয়া কহিলেন, তাই তো বলি রে , তোর মহেশ ভাটের এই দশা কেন । যত্নআত্তি করার তো কেউ নেই দেখছি । তা ওকে একটু ছেড়ে দে না । আপনি চড়াই করে আসুক । সবুজ ঘাস-টাস খাক । দুই ডজন সবুজ ঘাসে ১০০ গ্রাম খড়লিক্সের পুস্টি পাওয়া যায়, জানিস তো ?’ গফুর এইবার লজ্জায় মাথা নিচু করিয়া বলিল ‘সে তো ছেড়ে দেই বাবাঠাকুর , কিন্তু মহেশ ও যে জলসা ছেড়ে উঠতে চায়না । খাবার দাবারে একদম মন নেই । বড় লাচারে পড়ে গেছি ।’ তর্করত্ন খ্যাক করিয়া উঠেন । ‘তা বটে, যেমন চাষি তার তেমন বলদ । বিটিভি মিলেনা আর জলসা দেখা চাই’ এই বলিয়া তর্করত্ন পাশ কাটাইয়া হন হন করিয়া চলিয়া গেলেন ।

এমন অপমানে মহেশের কিঞ্চিত সাধ জাগিল তর্করত্নকের পশ্চাদে শিং দিয়া একখানা গুতা মারিবার । কিন্তু দুর্বল শরীরে সে আর ঝুকি নিলনা । কে জানে গুতা মারিতে গিয়া নিজেই যদি মাথা ঘুরাইয়া পড়িয়া যায় । এর চাইতে সুযোগ মতন একটা প্রতিশোধ নিলেই চলবে । # গফুরের ঘরে টেলিভিশন নিয়া নিত্য কলহ বাঁধে । সেদিন গফুর আর মহেশ যখন টিভিতে ফুটবল ম্যাচ উপভোগে ব্যাস্ত তখন আমিনা আসিয়া বলিল ‘বাবা, ভাত খাবে এসো’ । আমিনার মনে ক্ষীণ আশা বাবা উঠিয়া গেলে সে দুষ্টুর নাটক দেখিতে বসিবে । রিমোট দখলের ‘পাঁয়তারা’ বুঝিয়া গফুরও পাল্টা চাল দেয় ‘আমার গায়ে যে আবার শীত করে রে মা , জ্বর গায়ে এখন খাওয়া কি ঠিক হবে? আমিনা বলে ‘খাবার ঠান্ডা হইয়া যাবে যে ।’ ফুটবল ম্যাচ হইতে বাপ-মেয়ের রিমোট দখলের ম্যাচ বেশী জমিয়া যায় । মহেশও উত্তেজনা লইয়া রিমোট দখলের যুদ্ধ উপভোগ করিতে থাকে ।

এক পর্যায়ে গফুর তাহার ট্রাম্প কার্ড ছাড়িল ‘আমার মহেশ যে ফুটবল দেখিতে খুব ভালবাসেরে মা । খেলা শেষ হউক । এরপর খাই?’ গফুরের এমন চালে মহেশ বিস্মিত হইয়া পরে । সে তো ফুটবল ম্যাচ হইতে সিরিয়ালের প্যাঁচ অধিক পছন্দ করে । মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার থাকিলে অবশ্যই সে আমিনার পক্ষে থাকিত । তবে সব বুঝিয়াও সে চুপচাপ থাকে । পিতা ও কন্যার মাঝে এইযে একটু খানি ছলনার অভিনয় হইলো, অবুঝ বলদ হইয়াও সে তা খুব ভাল ভাবে টের পাইয়াছে । সপ্তাখানেক পর গফুর মিয়া একদিন চিন্তিত মুখে দাওয়ায় বসিয়া আছে । গতকল্য হইতে মহেশ নিখোঁজ । শেষরাতে দুইজন একসাথে বসিয়া শাহরুখ খানের ‘ডন’ ছবি উপভোগ করিয়াছিল ।

এরপর হইতে মহেশের আর খোঁজ মিলিতেছেনা । আমিনা খবর নিয়া আসিল, ঘটনা খারাপ । মহেশের উপর অভিযোগ গুরুতর । গফুর বুঝিতে পারিল ‘ডন’ ছবির প্রভাব মহেশের মস্ত্রিস্কে পড়িয়াছে । গত সন্ধ্যায় সে তর্করত্নর কালো গরুকে শিং দিয়া গুতা দিয়েছে । গুতা মারিয়া পালাইয়া যাইবার কালে ‘মহেশ কো পাকারনা মুশকিল নেহি, না মুমকিন হ্যায়’ বলিতে বলিতে ছুটিতেছিল । কিন্তু পোড়া কপাল ! পুলিশ তাহাকে ‘পাকাড়’ করিয়া শরীরের আকার বদলাইয়া দিয়াছে । সে এখন জেল হাজতে বন্দী । রাত্রির অন্ধকারে গফুর বংশির নিকট হইতে কঠিন শর্তে ঋণ আনিয়া মহেশকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করিল । পরদিন যথাস্থানে মহেশকে দেখা গেল । সেই বাবলা তলা, সেই দড়ি, সেই খুঁটা ।

এদিকে বংশীর ঋনের বোঝা মাথায় লইয়া গফুর ভাবিল ‘দুষ্টু গরুর চাইতে শুন্য গোয়াল ভাল' । তাই সে বৈশাখী অফারের নামে বিশেষ মূল্যছাড়ে মহেশকে বিক্রি করিয়া দেয়ার সিদ্ধান্ত লইলো । যাকে বলে লেজের দামে গরু । খবর পাইয়া এক চামড়া ব্যবসায়ি কিছু এডভান্স দিয়া মহেশকে খরিদ করিতে সম্মত হয় । পরদিন ক্রেতারা আসিয়া যখন মহেশের দড়ি খুলিতে ব্যস্ত তখন গফুরের তাহার মন পরিবর্তন করিয়া ফেলে, সাফ জানাইয়া দেয় মহেশকে সে বেচিবে না।

এরশাদ সাহেবের মতন এমন ক্ষনে ক্ষনে মত পরিবর্তনে ক্রেতারা মনক্ষুণ্ণ হইয়া ফিরিয়া যায় । আর এইসব কলহের কথা শুনিয়া জমিদার বাবু গফুরকে ডাকিয়া বলিলেন ‘গফুর তোকে যে আমি কি সাজা দেই ভেবে পাইনে । তোর সাজা যে হারে মওকুফ করিতেছি , লোকে আমারে শেষমেশ রাষ্ট্রপতি বলিয়া লজ্জা দিবে যে ।’তবে গফুর সেইবারের মত পার পাইয়া গেল । #জ্যৈষ্ঠ শেষ হইয়া আসে । টিভি দেখিতে বসিয়া গফুর খেয়াল করিল রিমোটে কাজ করিতেছেনা । আমিনার কাছে কারন জানিতে চাইলে সে বলিল ‘রিমোটের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে বাবা’ । গফুর মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, ব্যাটারি থাকবে কি করে ? বুড়ো বাপ কিছু দেখুক না দেখুক , মেয়ের সারাটা দিন টিভি দেখা চাই । পাকের ঘরে মন নেই আর সারা দিন ‘সাত পাঁকে বাঁধা’ । গফুর রিমোটের ব্যাটারি কিনিয়া আনিলো ঠিকই কিন্তু ঘরে ফিরিয়া টেলিভিশন পাইল না । বংশীর ঋণের টাকা সময় পরিশোধ না করায় সে উহা কব্জা করিয়াছে । গফুর গালে হাত দেয় , আমিনা কপালে হাত দেয় আর মহেশ তৎক্ষণাৎ জাবর কাটা বন্ধ করিয়া দেয় । টানা কয়েকদিন টেলিভিশন দেখিতে না পাইয়া মহেশ আধপাগল হইয়া যায় ।

আর এর কিছুদিন পরই মহেশের উপর আরেকবার সন্ত্রাসী করমকান্ডের অভিযোগ পাওয়া গেল । জমিদারের বাড়ির জানালায় উঁকি দিয়া লুকাইয়া টেলিভিশন দেখিবার কালে দুর্ঘটনাবশত মহেশ জানালার কাচ শিং দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিছে । পরিশেষে পলায়নের সময় জমিদারের গর্ভবতী গাভীকে একখানা গুতাও দিয়া আসিছে । ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখিলেই ভয় পাওয়ার কথা অথচ ভয় তো দূরে থাকে, ঘরে ফিরিয়া মহেশকে আরামসে ঘাস চিবাইতে দেখিয়া গফুর দিক্বিদিক জ্ঞ্যানশুন্য হইয়া গেল । তৎক্ষণাৎ গফুর পাশে থাকা লাঙল দিয়া সজোরে মহেশের মাথায় আঘাত করিয়া বসিল । মহেশের অনাহারকিস্ট শীর্ণদেহ ভুমিতলে লুটাইয়া পড়িল । আমিনা দুই কানে হাত দিয়া চীৎকার করিয়া বলিল ‘কি করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল ।’ সেকেন্ডের ব্যবধানে তাদের ভুল ভাঙ্গিল । মাটি হইতে মাথা তুলিয়া মহেশ এদিক ওদিক তাকাইয়া কহিল, আমি কে? আমি এখানে কেন? আপনারা কারা?’ তাহারা বুঝিতে পারিল মহেশের হার্ডডিস্ক ফরম্যাট হইয়া গেছে । দুর্বল গফুর কোন মতে আরো একবার লাঙল তুলিয়া আঘাত করিতে গিয়া নিজেই মাথা ঘুরাইয়া পড়িয়া গেল ।

সিনেমার সূত্র অনুযায়ী মাথায় আরেকবার বাড়ি পড়িলে হয়ত মহেশের স্মৃতিশক্তি ফেরত আসিত, কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ! তবে, জ্ঞান ফিরিলে গফুরের রাগ পড়িয়া যায় । সুস্থ হইয়া অক্লান্ত পরিশ্রমে কিছু টাকা যোগাড় করিয়া গফুর বংশীর ঋন পরিশোধ করিল । বাড়ির টেলিভিশন বাড়িতে ফেরত আসিল । সবকিছু প্রায় আগের মত হইলেও গফুর আর এখন মহেশের অজুহাতে রিমোট দখল করিয়া রাখিতে পারেনা । স্মৃতিভ্রষ্ট মহেশ যে এখন আর টেলিভিশন দেখিয়া মজা পায়না । বিজ্ঞাপন বিরতিতেই বিরতির আগের কাহিনি বেমালুম ভুলিয়া যায় । তাই সে সারাদিন সবুজ ঘাস, এক কাপ খরলিক্স আর জাবর কাটিকে কাটিতে প্রকৃতি দর্শনেই সময় পার করিয়া দেয় ।

source : https://www.facebook.com/notes/collected-notes-and-discussion/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%89-%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A7%8E%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87/569095353106383

Comments

Popular posts from this blog

The Superstar Of Hell

Load base64 image data in img html element using javascript

মাহরাম