যদি উলঙ্গ হতে চান

সাদাকালো চলচ্চিত্রের যুগকে বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ বলা হয়। সেসময়ে তৈরি হয়েছিল বহু কালজয়ী চলচ্চিত্র। এগুলোর নির্মাণশৈলী ছিল অনন্য। তৈরি হয়েছিল অনেক সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র।

বলা হয়ে থাকে, সিনেমা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই বুঝি, একটি দেশের চলচ্চিত্রে সেই দেশের চালচিত্র পাওয়া যায়।

সাদাকালো যুগের ছবিতে নায়িকাদের প্রধান পোশাক ছিল শাড়ি। কোনো কোনো ছবিতে ধনীর দুলালি পশ্চিমা-সংস্কৃতির পোশাক পরলেও, শাড়ির একচেটিয়া প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো ছবিতে আমি পশ্চিমা পোশাকে নারীদের দেখিনি। আর তা দেখানো সম্ভবও ছিল না। কেননা, তাহলে সেই সিনেমা তার বাস্তবতা হারাত। আর সাধারণ মানুষও সেটা সহজে গ্রহণ করত না। কারণ, তাদের মন-মানসিকতা তাতে অভ্যস্ত ছিল না। এক মাসের বাচ্চাকে যেমন ছয় মাসের বাচ্চার খাবার দেওয়া যায় না, সেই সময়টা ছিল এমনই।

ধীরে ধীরে সিনেমাশিল্প বিকাশ লাভ করল। মুক্তিযুদ্ধের পরে কিছু কিছু ছবিতে কেবল গানের দৃশ্য রঙিন ক্যামেরায় ধারণ হওয়া শুরু হলো। পাল্টে যেতে থাকল নায়িকাদের পোশাকের ধরন। আর চলচ্চিত্র যখন পুরোপুরি রঙিন ক্যামেরায় নির্মিত হতে শুরু করল, তখন মূলধারার বেশিরভাগ বাণিজ্যিক সিনেমাতেই নায়িকাদের পোশাক—বিশেষ করে গানগুলোতে—খাপতে শুরু করল। কিন্তু এতে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়ল না। কারণ, ধীরে ধীরে তাদেরকে ছয় মাসের বাচ্চায় এবং পরে এক বছরের বাচ্চায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। ফলে ষাটের দশকে যা দেখলে তারা হয়তো হায় হায় করত, আশির দশকে তারা তাতে কোনো রা’ই করল না। তাদের ব্রেনকে ধীরে ধীরে এমনভাবে এনজিনিয়ারিং করা হয়েছে যে, সব তখন সয়ে গেছে। যার ফলে একসময় যেখানে নায়ক-নায়িকার চুম্বন দৃশ্য বোঝাতে ক্যামেরা ভিন্ন দিকে সরে যেত, লাল-নীল ফুল নড়ত, এখন তা সরাসরি ধারণ করা হয়। আকাশ-সংস্কৃতির এই যুগে এটা আসতে বরং অনেক দেরিই হয়েছে বলা যায়! কারণ এরচেয়েও উত্তেজক দৃশ্য দেখে দেখে দর্শক এখন অভ্যস্ত।

এদেশের নাটকই বা কম কী। বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো গজিয়ে ওঠার আগে বিটিভিতে নারী চরিত্র সালোয়ার কামিজ বা ফতুয়া পরলে ওড়না ছাড়া দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না। কিন্তু স্যাটেলাইট চ্যানেলের জোয়ার শুরু হওয়ার পর সেখানেও ধীরে ধীরে নৈতিকতার মানদণ্ড নামতে শুরু করে। ইসলামে আসার পর যেহেতু এগুলো আর দেখা হয় না, তাই জানি না এখনকার নাটকে কী অবস্থা। কিন্তু ২০১০ সালের দিকে যা দেখেছি, এখন সেটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

এর সবই হয়েছে, সুকৌশলে। ধীরে ধীরে। একটু একটু ডোজ দিয়ে। কারণ, যারা এগুলোর পেছনের কলকাঠি নাড়েন, তারা খুব ভালো করেই স্থানীয় মানুষের মানসিকতা বোঝেন। তারা জানেন যেকোনো পরিবর্তন—হোক তা ভালো বা খারাপ—রাতারাতি হওয়া অসম্ভব। যে-মেঘ তাদের গুরুরা জড়ো করেছিলেন, আজ তারা সেখান থেকে প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবকিছুর আঘাত লাগছে কেবল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের উপর। একটি বিশ্বাসের উপর। একটি জীবনব্যবস্থার উপর।

ইসলাম।

ইসলাম বাদে আর কোনো আদর্শ মানুষকে সার্বিক দিকনির্দেশনা দেয় না। ব্যক্তি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব পরিচালনার যাবতীয় মূলনীতি ও বিধি এর মধ্যে আছে। ইসলাম শুধু একজন ব্যক্তির কথা চিন্তা করে না, গোটা মানবজাতির কথা চিন্তা করে।

অন্যদিকে সামাজিক ও বৈশ্বিক পটপরিবর্তনের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়েন, তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থই মুখ্য। ফলে বাকি সব চুলোয় যাক, নিজে বাঁচলে বাপের নাম—এরকম একটা মনোভাব তাদের। তাদের এই অস্থির আদর্শ কায়েমের পথে একমাত্র বাধা ইসলাম। কাজেই একে যদি নিশ্চিহ্ন করা যায়, তাহলে সফল হবে তাদের কায়েমি স্বার্থ। কিন্তু এরা তো বোকা নন। তাই তারা ইসলামকে সরাসরি আক্রমণ করেন না। কারণ, এটা সত্য বিশ্বাস। কাজেই বিশ্বাসকে যদি সরাসরি আঘাত করা হয়, তাহলে পাল্টা জবাব আসবে সবশ্রেণির মানুষের কাছ থেকে। আর যদি কৌশলে একটু একটু করে একটা দুটা পাতা ছিড়তে ছিড়তে কাণ্ডের দিকে আগানো হয়, তাহলে সবশ্রেণির মানুষ সেটা বুঝবে না। আমলে নেবে না।

যারা দূরদর্শী, তারা ভণ্ড ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের যেকোনো চাল সহজেই ধরতে পারেন। তাই আগেভাগেই সতর্ক করে দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গা করেন না। ওসব গুপ্তকৌশলিরা ভাইল দিয়ে মিশে মিশে, আস্তেধীরে তাদের ‘ছাঁট’তে থাকেন। এভাবে কখন যে সে উলঙ্গ হয়ে যায়, সে ব্যক্তি নিজেই বোঝে না।

এভাবে ভালোই চলছিল তাদের।

এই প্রবাহে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। বাড়ি বাড়ি যেয়ে তা‘লীমের মাধ্যমে প্রাথমিক পরিবর্তন আসে মা-খালাদের মাঝে। বিশেষ করে তাদের পর্দায়। এমন না যে এর আগে তারা পর্দা করতেন না, তবে সেটা আল্লাহর দেওয়া বিধি অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ছিল না। কিন্তু এসব তা‘লীমের মাধ্যমে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্দা করতে শুরু করেন। পুরুষদের মধ্যে সে তুলনায় পরিবর্তন কমই দেখেছি—অন্তত বাহ্যিক ক্ষেত্রে। তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে কিছু কিছু ভাই হয়তো নামাজমুখী হতেন, তবে সেটা খুব বেশি ছিল না।

একবিংশ শতাব্দির শুরুতে ইন্টারনেটের কল্যাণে এই পরিবর্তন কিছুটা বেগবান হয়। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই পরিবর্তন বেশি চোখে পড়ে। নতুনভাবে তারা ইসলামকে জানতে শেখে। বুঝতে শেখে। চর্চা করতে শুরু করে। নিজেদের বদলে ফেলে আমূলে।

তবে উল্টোটাও কম হয়নি। ২০১১ সালের দিকে আল্লাহ যখন আমাকে ইসলামে আনেন, তখন ইসলামবিরোধী ও বিদ্বেষী ওয়েবসাইট, ব্লগের প্রাধান্য ছিল বেশি। ইসলাম নিয়ে কোনো বিষয়ে গুগলে সার্চ দিলে ওসব ব্লগ আর ওয়েবপাতা গুলির মতো ছুটে আসত। বিগত ৩-৪ বছরে সেটা অবশ্য বেশ কমেছে।

তো বাংলাদেশের ইসলামে যখন আবার বসন্তের ছোঁয়া লাগা শুরু হলো, উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থা থেকে মনমগজে ঈমানের পোশাক পরা হতে শুরু হলো, তখন আবার শুরু হলো ‘ছাঁটা’। আর এবারে কচুকাটা।

‘বিয়ে’র মতো নিরীহ বিষয় নিয়ে সেমিনার বন্ধ করে দেওয়া হলো। একের পর এক আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশেষজ্ঞদের আসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। বন্ধ হলো একটি ইসলামি এবং আরেকটি ইসলামি ভাবধারার চ্যানেল।

এতকিছুর পরও দেশের আনাচেকানাচে ইসলামি ভাবধারার বিভিন্ন স্কুল গড়ে উঠছিল। হালাকা (ইসলামি আলোচনা সভা) চলছিল। স্যাটেলাইটে ইংরেজি ও বাংলায় দুটো ইসলামি চ্যানেল হয়ে উঠেছিল মিডিয়াতে ইসলামের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধি। কিন্তু গতবছরে এক সন্ত্রাসী হামলার পর হাস্যকর অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই চ্যানেল দুটো। এক অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বিভিন্ন ইসলামি কর্মকাণ্ডের উপর। এখন পর্যন্ত এসব অভিযোগের কোনো কুলকিনারা হয়নি।
সেই একই অভিযোগের রেশ ধরে একে একে বন্ধ করা হয় বিভিন্ন ইসলামি ভাবধারার স্কুল। আজও তা চলছে। অভিযোগ: এগুলো জঙ্গি তৈরির ‘উর্বর’ ক্ষেত্র! সঠিক ইসলাম আর ইসলামি মূল্যবোধ শেখালে মানুষ জঙ্গি হয়? অথচ সেই সন্ত্রাসী হামলায় যেসব স্কুল ও ইউনিভার্সিটি জড়িত ছিল, সেগুলো দিব্যি চলছে। মাঝখানে জঙ্গি জিগির তুলে বিনাপ্রমাণে, একশ্রেণির হলুদ মিডিয়ার লাগাতার মিথ্যাচার আর ঘৃণার বলি হচ্ছে এসব স্কুল।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, এসব স্কুলে জঙ্গিবাদে উসকে দেওয়া হয়, তাহলে কয়েকদিন আগে যে-গ্যাং বয় আরেক গ্যাং বয়ের হাতে খুন হলো, সেটার শিক্ষা কি সে তার স্কুল থেকে পেয়েছে? সেই স্কুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? কেন সন্ত্রাসী হামলায় জড়িতদের সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নিয়ে শুধু ধরে ধরে ইসলামি ভাবধারার স্কুলগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে? একের পর এক যেসব ‘জঙ্গি’দের মারা হলো তারা কোন ইসলামিক স্কুলের? কোন মাদরাসার?

ইসলাম নিয়ে কথা বলা প্রতিটা মানুষ, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, স্কুল, মাদরাসা আজ ওদের টার্গেট। গত ১০-১৫ বছরে উলঙ্গপনা ছেড়ে বিভিন্ন তা‘লীম, তাবলীগ, দা‘ওয়াহ, লেকচার, চ্যানেল, বই আর স্কুলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে যারা আবার ইসলামের কোটরে ফেরত এসেছেন, এদের সবাই ওদের নিশানা। একে একে এদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন না-করে ওরা থামবে না। লক্ষ্য একটাই যেভাবেই হোক ইসলামের প্রচার প্রসার ও সঠিক শিক্ষা দাবিয়ে রাখা।

ওদের চাওয়া লুতুপুতু ইসলাম: “আপনি নামাজ পড়বেন পড়ুন, কিন্তু সাথে পর্দাহীন নারী-পুরুষদের সাথে অবাধে মিশুন। আপনি রোজা রাখবেন রাখুন, কিন্তু সাথে সাথে অবৈধ সম্পর্কেও জড়ান। আপনি যাকাত দিবেন দিন, কিন্তু সাথে সাথে সিনেমা-নাটক দেখুন, গান শুনুন। আপনি হাজ্জ করবেন করুন, কিন্তু সাথে সাথে সেক্যুলার ধর্মের অনুগত হোন। আর তাছাড়া একসময় আপনি এভাবে ধীরে ধীরে নামাজ-রোজা-যাকাত-হাজ্জ এমনিতেই ছেড়ে দেবেন। আমাদের বলা লাগবে না। আপনি বুঝবেনও না কখন যে ঈমানের পোশাক খুলে পড়ে আপনি দিগম্বর হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ওসব প্রতিষ্ঠান, চ্যানেল, স্কুল, মাদরাসা থাকলে তো আমাদের এই চাওয়া পূরণ হবে না। তাই মুখে যতই বলি আদর্শের জবাব আদর্শ দিয়ে দিতে হয়, নিজেদের ‘স্বপ্ন’ পূরণে ক্ষমতা খাটাতে আমরা পিছ পা হই না।”

আমরা সাধারণ মুসলিমেরা যদি এখনই সচেতন না-হই, তাহলে একদিন নিজের সামনেই হয়তো নিজের বউ, কন্যা, মা, বাবা, ছেলে, স্বামী উলঙ্গ হয়ে পড়বে। তবে সেদিন তাতেও আমাদের কোনো বিকার হবে না। কারণ, ততদিনে আমাদের মনমগজকে এমনভাবে এনজিনিয়ারিং করা হবে, যার ফলে ষাটের দশকের দর্শক আশির দশকে স্বল্পবসনা নারীদের দেখতে যেমন অস্বস্তি বোধ করেননি, আমাদেরও তেমনি কোনো অস্বস্তি লাগবে না।

source : https://www.facebook.com/notes/masud-shorif/%E0%A6%AF%E0%A6%A6%E0%A6%BF-%E0%A6%89%E0%A6%B2%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%A8/10154110109686332

Comments

Popular posts from this blog

The Superstar Of Hell

অ্যাডাম টিজিং

PHP তে HTML Escape করা